ইসরায়েলের পাহলভী-প্রেম: ইতিহাসের ছায়ায় কৌশলের বিস্তার

ইসরায়েল কেন ইরানের সিংহাসনে পাহলভী রাজবংশের পুনর্বাসনের জন্য এত আগ্রহী, এই প্রশ্নটি এখন আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে নেতানিয়াহু সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ও বিবৃতি, যেগুলো ইরানের নির্বাসিত যুবরাজ রেজা পাহলভীর সাথে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপনের দিকে ইঙ্গিত করে, তা এই জিজ্ঞাসাকে আরও জোরালো করে তোলে। তবে এটা কি কেবল ঐতিহাসিক সম্পর্কের নস্টালজিয়া, নাকি এর পেছনে রয়েছে গভীর কৌশলগত পরিকল্পনা? বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, ইসরায়েলের এই আগ্রহ মূলত ইরানকে অস্থিতিশীল করার একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের অংশ।

ইতিহাস বলছে, পাহলভী রাজবংশ কখনই ইরানি জনগণের সমর্থনের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেনি। ১৯২১ সালে ব্রিটিশ সমর্থনে রেজা খান অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। পরে তাঁর ছেলে মোহাম্মদ রেজা শাহ যখন দুর্বল হয়ে পড়েন এবং ইরানের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেক তেল শিল্প জাতীয়করণ করতে উদ্যোগী হন, তখন যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ এবং ব্রিটেনের এমআই৬ ১৯৫৩ সালে একটি অভ্যুত্থান ঘটিয়ে মোসাদ্দেককে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে পুনরায় শাহকে প্রতিষ্ঠিত করে। এই ঘটনাগুলো পাহলভী শাসনের পশ্চিমা নির্ভরতা ও ‘পুতুল রাজনীতির’ বাস্তব চিত্র তুলে ধরে।

এই সময়েই ইরান এবং ইসরায়েলের মধ্যে কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মোসাদ ইরানের সাভাককে প্রশিক্ষণ দেয় এবং গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানে জড়িত থাকে। এমনকি ইরানকে ব্যবহার করে ইসরায়েল ইরাকের অভ্যন্তরে কুর্দি বিদ্রোহীদের সহায়তা করত, যার মাধ্যমে বাগদাদ সরকারকে দুর্বল করা হতো। পাশাপাশি ইরান এবং ইসরায়েল একত্রে ‘প্রজেক্ট ফ্লাওয়ার’-এর মতো সামরিক প্রকল্পে অংশ নেয়, যা পারমাণবিক সহায়তা এবং ক্ষেপণাস্ত্র উন্নয়নে ভূমিকা রাখে।

শাহের আমলে ইরান ইসরায়েলকে তেল সরবরাহ করত এবং ইরানীয় এয়ারলাইন্স ইহুদি শরণার্থীদের ইসরায়েলে পৌঁছাতে সহায়তা করত। একই সময়ে সিআইএ, মোসাদ এবং ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ত্রিপক্ষীয়ভাবে ‘ট্রাইডেন্ট নেটওয়ার্ক’ গঠন করে, যার মাধ্যমে ইরান হয়ে ওঠে মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা গোয়েন্দা কার্যক্রমের এক কেন্দ্রীয় ঘাঁটি।

এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লবে একেবারে ধসে পড়ে। বিপ্লবের মাধ্যমে ইরান ইসরায়েলের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং শাহের পুতুল শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটায়। এর ফলে ইসরায়েল এক গুরুত্বপূর্ণ মিত্রকে হারায় এবং তেহরান হয়ে ওঠে ইসরায়েলের এক কঠিন প্রতিপক্ষ।

তবে ইসরায়েলের দৃষ্টিকোণ থেকে এখনো সেই ‘সুবর্ণ সময়ের’ পুনরাবৃত্তির আশার মৃত্যু হয়নি। রেজা পাহলভীকে সামনে রেখে ইসরায়েল এক নতুন রাজনৈতিক প্যাকেজ তৈরির চেষ্টা করছে। তাদের ধারণা, যদি ইরানে কোনোভাবে রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়, তবে ইরান পুনরায় ইসরায়েল-সমর্থিত ও পশ্চিমা মিত্রশক্তির একটি অংশ হয়ে উঠবে। এর ফলে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ও আঞ্চলিক প্রভাব খর্ব হবে, যা ইসরায়েলের দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা স্বার্থে সহায়ক হবে।

এই কৌশলের আরও একটি দিক হলো, ইরানের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক বিভেদ সৃষ্টি করা। রাজতন্ত্র বনাম ইসলামি শাসন ব্যবস্থার বিতর্ক পুনরুজ্জীবিত হলে ইরানের মধ্যে গৃহবিবাদের সম্ভাবনা তৈরি হবে, যা একটি বহিরাগত হস্তক্ষেপের ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। একই সঙ্গে পশ্চিমা গণমাধ্যমে রেজা পাহলভীকে ‘স্বচ্ছ, উদার ও আধুনিক’ রাজনৈতিক বিকল্প হিসেবে তুলে ধরা হয়, যা পশ্চিমা জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

তবে বাস্তবতা হলো, ইরানের জনগণের মধ্যে রাজতন্ত্রের প্রতি সমর্থন খুবই সীমিত। বিশেষ করে বিপ্লব-পরবর্তী প্রজন্ম যারা সাম্রাজ্যবাদ ও একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা জাতীয় মনোভাব নিয়ে বেড়ে উঠেছে, তাদের কাছে রেজা পাহলভী কোনও বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প নন। তাঁকে অনেকেই পশ্চিমা এজেন্ডার বাহক হিসেবে দেখেন।

ফলে, ইসরায়েলের এই কৌশল কার্যকর হতে গেলে অনেকগুলো শর্ত পূরণ হতে হবে—যার মধ্যে অন্যতম হলো অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ, আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং ইরানের বর্তমান সরকারের সম্পূর্ণ ভাঙন। বাস্তবতা বলছে, এসব শর্ত পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত সীমিত।

তবে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ইসরায়েলের পাহলভী-প্রেম আসলে ঐতিহাসিক সম্পর্কের স্মৃতিচারণ নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যে একটি নতুন ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্য তৈরির চেষ্টা। এই ভারসাম্যে ইরান যেন আর পশ্চিম-বিরোধী শক্তি না হয়ে বরং ইসরায়েলের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়, সেটাই তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। তবে এই উচ্চাভিলাষ বাস্তবায়নের পথে ইরানের জনগণের সচেতনতা ও রাজনৈতিক বাস্তবতা বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *