নিচে আল জাজিরার ১৯ জুন, ২০২৫-এ প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে একটি বিস্তারিত বিশ্লেষণ তুলে ধরা হলো:
ইরান বিরোধী যুদ্ধ নিয়ে ইজরায়েল কীভাবে নিজের গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করে?
ইজরায়েল-ইরান যুদ্ধ পরিস্থিতির মাঝে দেশটির সরকার ও সামরিক বাহিনী অভ্যন্তরীণ গণমাধ্যমের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। রিপোর্ট প্রকাশের আগে অনুমোদন, সামরিক সেন্সরশিপ, ও জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে সংবাদ আটকে দেওয়া—এই সবই এখন ইজরায়েলি সাংবাদিকদের নিত্যনৈমিত্তিক বাস্তবতা।
🛡️ সামরিক সেন্সরশিপের কাঠামো
ইজরায়েলে Israel Defense Forces (IDF)-এর অধীনে একটি Censorship Unit রয়েছে, যার কাজ হলো ‘জাতীয় নিরাপত্তা’ বিষয়ক সংবাদের ওপর নজরদারি। ইরানের সাথে চলমান সংঘাতের সময়ে এই সেন্সরশিপ আরও কড়াকড়ি করা হয়েছে।
সাংবাদিকদের বাধ্য করা হচ্ছে:
- আগে থেকে সব সংবাদ সেন্সর বিভাগে জমা দিতে
- এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেও কিছু পোস্ট করার আগে অনুমোদন নিতে
বিশেষ করে যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি, সেনাবাহিনীর কৌশল, কিংবা ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যাপারে কোনো তথ্য অনুমতি ছাড়া প্রকাশ করা আইনত দণ্ডনীয় হয়ে গেছে।
🔒 কী ধরণের তথ্য নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে?
১. ইরান থেকে ছোঁড়া ড্রোন বা ক্ষেপণাস্ত্র কোথায় আঘাত হেনেছে
→ এই তথ্য সেন্সর ব্যতীত প্রকাশ করা নিষিদ্ধ।
২. ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর অবস্থান, ঘাঁটি বা কৌশলগত প্রস্তুতি
→ এই বিষয়ে রিপোর্ট করা প্রায় অসম্ভব।
৩. বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতি বা ঘরবাড়ি ধ্বংস
→ এমন তথ্য “দুশমনকে সাহায্য করতে পারে” এমন অজুহাতে সেন্সর করা হয়।
🧑💻 সাংবাদিকদের ওপর চাপ ও আতঙ্ক
অনেক সাংবাদিক জানিয়েছেন, তারা এখন এমন একটা পরিবেশে কাজ করছেন যেখানে ‘সত্য প্রকাশ’ নয় বরং ‘প্রাণ বাঁচানো’টাই গুরুত্বপূর্ণ। কেউ কেউ বলেছেন—
“আমরা জানি কী ঘটছে, কিন্তু সেটা জনগণকে বলতে পারি না। কারণ আমরা জানি, বললেই হয়তো আমাদের বিরুদ্ধে মামলা হবে বা লাইসেন্স বাতিল হবে।”
🧨 আন্তর্জাতিক মিডিয়া বনাম স্থানীয় মিডিয়া
আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলো যেমন আল-জাজিরা, বিবিসি বা রয়টার্স কিছুটা স্বাধীনভাবে রিপোর্ট করতে পারলেও, ইজরায়েলি নাগরিক বা মিডিয়ার সাংবাদিকরা তা পারেন না। কারণ তারা আইডিএফ সেন্সর ইউনিটের অধীন।
যদি তারা সেন্সরবিহীন তথ্য প্রকাশ করে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা হতে পারে।
💬 যুদ্ধকালীন “রাষ্ট্রীয় ঐক্য”র অজুহাত
নেতানিয়াহু সরকার বলছে, এই সব সেন্সরশিপ জাতীয় স্বার্থে জরুরি। যুদ্ধকালীন সময়ে “রাষ্ট্রীয় ঐক্য” ধরে রাখতেই নাকি মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য।
কিন্তু মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এটি একটি পরিষ্কারভাবে তথ্যচেপে রাখার কৌশল। প্রকৃত অর্থে জনগণ জানতে পারছে না বাস্তবে কী ঘটছে, কতজন নিহত বা আহত হচ্ছে।
🧯 একপাক্ষিক তথ্য ও রাজনৈতিক এজেন্ডা
স্থানীয় গণমাধ্যমকে বাধ্য করা হচ্ছে শুধুমাত্র রাষ্ট্রের বার্তা প্রচার করতে—যেখানে ইজরায়েল সবসময় “বিচক্ষণ ও আত্মরক্ষামূলক”, আর ইরান হচ্ছে “সন্ত্রাসী ও আগ্রাসী”।
স্বাধীন বিশ্লেষণ, ভিন্নমত বা ইরানি দৃষ্টিভঙ্গির জায়গা প্রায় নেই।
📉 পরিণতি: গণতন্ত্রের ক্ষতি
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইজরায়েলের এই মিডিয়া কৌশল তাদের “গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।”
যুদ্ধকে কেন্দ্র করে সত্য গোপন করাটা যেমন মানবাধিকারের পরিপন্থী, তেমনি এটি দীর্ঘমেয়াদে সরকারকে অবিশ্বস্তও করে তুলছে।
ইরানের সঙ্গে যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ইজরায়েল তার অভ্যন্তরীণ গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে কার্যত স্থগিত করেছে। সত্যিকারের সংবাদ ও বিশ্লেষণ প্রকাশে সাংবাদিকরা ভয়, সেন্সর, এবং সরকারের চাপের মধ্যে কাজ করছেন। এটি শুধু মিডিয়ার স্বাধীনতার সংকট নয়, বরং গণতান্ত্রিক সমাজের অস্তিত্বকেও চ্যালেঞ্জ করছে।